Executive Summary
Youtube Video
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
চীন ও পাকিস্তানের মধ্যেকার সম্পর্ক ঐতিহাসিক ভাবেই বন্ধুত্বপূর্ণ। স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত, উভয় দেশই একে অপরের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছে। এই সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো প্রতিরক্ষা সহযোগিতা। ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, পাকিস্তান চীনের কাছ থেকে সামরিক সরঞ্জাম ও প্রযুক্তিগত সহায়তা পেয়েছে।
জেএফ-১৭ থান্ডার: সহযোগিতার প্রতীক (Wikipedia)
চীন-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো জেএফ-১৭ থান্ডার যুদ্ধবিমান। এটি একটি হালকা ওজনের, একক ইঞ্জিনবিশিষ্ট, মাল্টিরোল কমব্যাট এয়ারক্রাফট যা পাকিস্তান অ্যারোনটিক্যাল কমপ্লেক্স (PAC) এবং চীনের চেংদু এয়ারক্রাফট ইন্ডাস্ট্রি গ্রুপ (CAC) যৌথভাবে তৈরি করেছে।
- উন্নয়ন ও উৎপাদন: জেএফ-১৭ থান্ডারের উন্নয়ন শুরু হয় ১৯৯০-এর দশকে। এর উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান বিমান বাহিনীর (PAF) পুরনো দিনের যুদ্ধবিমানগুলোর প্রতিস্থাপন করা এবং একটি সাশ্রয়ী মূল্যের আধুনিক যুদ্ধবিমান তৈরি করা। এই প্রকল্পের মাধ্যমে পাকিস্তান শুধুমাত্র যুদ্ধবিমানই পায়নি, বরং বিমানের নকশা, উন্নয়ন এবং উৎপাদনেও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।
- বৈশিষ্ট্য ও সক্ষমতা: জেএফ-১৭ একটি চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি বিভিন্ন ধরনের এয়ার-টু-এয়ার এবং এয়ার-টু-গ্রাউন্ড অস্ত্র বহন করতে সক্ষম। এর মধ্যে রয়েছে বিয়ন্ড ভিজ্যুয়াল রেঞ্জ (BVR) ক্ষেপণাস্ত্র, অ্যান্টি-শিপ মিসাইল এবং লেজার-গাইডেড বোমা। এর আধুনিক অ্যাভিওনিক্স এবং ককপিট ডিসপ্লে পাইলটদের যুদ্ধক্ষেত্রে কার্যকরভাবে কাজ করতে সহায়তা করে।
- পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে ভূমিকা: জেএফ-১৭ বর্তমানে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করছে। এটি বিভিন্ন ধরনের মিশনে ব্যবহৃত হচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে আকাশ প্রতিরক্ষা, স্থল আক্রমণ এবং নজরদারি। এই বিমানটির নির্ভরযোগ্যতা এবং কার্যকারিতা একাধিকবার প্রমাণিত হয়েছে।
Source: Wikipedia
জে-১০সি: সক্ষমতার নতুন দিগন্ত (Wikipedia)
জেএফ-১৭ ছাড়াও, পাকিস্তান সম্প্রতি চীনের কাছ থেকে আরও উন্নত যুদ্ধবিমান সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো চেংদু জে-১০সি যুদ্ধবিমান।
- অধিগ্রহণ ও তাৎপর্য: ২০২১ সালে, পাকিস্তান চীনের কাছ থেকে জে-১০সি যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই বিমানগুলো PAF-এর সক্ষমতাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। জে-১০সি একটি মাল্টিরোল ফাইটার জেট যা উন্নত রাডার সিস্টেম, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার স্যুট এবং বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র বহন করতে সক্ষম।
- প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য: জে-১০সি কে প্রায়শই ৪.৫ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান হিসেবে গণ্য করা হয়। এতে রয়েছে অ্যাক্টিভ ইলেকট্রনিক্যালি স্ক্যানড অ্যারে (AESA) রাডার, যা একাধিক লক্ষ্যবস্তুকে একই সাথে ট্র্যাক করতে এবং আক্রমণ করতে পারে। এটি চীনের তৈরি সবচেয়ে উন্নত যুদ্ধবিমানগুলোর মধ্যে অন্যতম।
- অপারেশনাল প্রভাব: জে-১০সি অন্তর্ভুক্তির ফলে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর আকাশ যুদ্ধের সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যেও প্রভাব ফেলেছে। সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, এই বিমানগুলো ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে সক্রিয়ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
-
ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে প্রভাব
চীন থেকে প্রাপ্ত এই যুদ্ধবিমানগুলো ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ২০১৯ সালে বালাকোট বিমান হামলার পর পাকিস্তান দাবি করে যে তারা ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করতে চীনা প্রযুক্তির সহায়তা নিয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম, যেমন রয়টার্স এবং নিউজউইক, সাম্প্রতিক সময়ে (মে ২০২৫) রিপোর্ট করেছে যে মার্কিন কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে চীনা তৈরির জে-১০সি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে পাকিস্তান ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করেছে। এই ঘটনাগুলো এই অঞ্চলের সামরিক সমীকরণে চীনা প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান গুরুত্বকে আরও জোরালোভাবে তুলে ধরেছে।
পাকিস্তানের মতে, জেএফ-১৭ এবং বিশেষ করে অত্যাধুনিক জে-১০সি যুদ্ধবিমানগুলো ভারতীয় বিমান বাহিনীর আধুনিক যুদ্ধবিমানগুলোর (যেমন রাফাল) সাথে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম। এটি পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা সক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী করেছে এবং ভারতের উপর একটি প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করছে। এই বিষয়গুলি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলির মনোযোগ আকর্ষণ করেছে, যা চীনের প্রতিরক্ষা শিল্পের বিকাশের একটি প্রমাণ হিসাবেও দেখা হচ্ছে।
চীনের জন্য কৌশলগত সুবিধা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
পাকিস্তানের সাথে এই প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চীনের জন্যও একাধিক কৌশলগত সুবিধা নিয়ে এসেছে:
- অস্ত্র পরীক্ষা ও উন্নয়ন: পাকিস্তানকে অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান সরবরাহ করার মাধ্যমে চীন তার সামরিক প্রযুক্তির বাস্তব-জগতের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার সুযোগ পায়। এই অভিজ্ঞতা চীনের নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্পের উন্নয়নে সহায়ক এবং আন্তর্জাতিক বাজারে চীনা অস্ত্রের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারে। সিএনএন-এর একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে এই ধরনের ঘটনাগুলি চীনের প্রতিরক্ষা স্টকগুলির মূল্যবৃদ্ধিতেও প্রভাব ফেলেছে।
- ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব: পাকিস্তানের সাথে শক্তিশালী সামরিক সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে চীন এই অঞ্চলে তার প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। এটি ভারতকে চাপে রাখার এবং এই অঞ্চলে চীনের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা করার একটি মাধ্যম।
- অর্থনৈতিক সুবিধা: পাকিস্তানের কাছে অস্ত্র বিক্রি চীনের প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়ের উৎস।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন যে পাকিস্তানের দ্বারা চীনা যুদ্ধবিমান এবং ক্ষেপণাস্ত্রের সফল ব্যবহার চীনের প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য একটি বড় বিজ্ঞাপন হিসেবে কাজ করছে। এটি অন্যান্য দেশকেও চীনা সামরিক প্রযুক্তি ক্রয়ে উৎসাহিত করতে পারে, যা বিশ্বব্যাপী অস্ত্রের বাজারে চীনের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে।
উপসংহার
চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিমান সহযোগিতা একটি চলমান এবং বিকশিত প্রক্রিয়া। এই সহযোগিতা যেমন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা সক্ষমতাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে, তেমনি আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যেও পরিবর্তন এনেছে। চীনের জন্য এটি শুধুমাত্র একটি বাণিজ্যিক সম্পর্ক নয়, বরং এর ভূ-রাজনৈতিক এবং কৌশলগত গুরুত্বও অপরিসীম। এই প্রেক্ষাপটে, আগামী দিনে এই অঞ্চলের নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে এই সামরিক সহযোগিতা একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
Comments 0
No comments yet. Be the first to comment!
Sign in to leave a comment.